অ্যালার্জি সাধারণত সবার শরীরে থাকে, তবে সবার শরীরে ইমিউনি সিস্টেম আলাদা হওয়াতে যাদের ইমিউনি সিস্টেম তুলনামূলক কম শক্তিশালী তাদের শরীরেই অ্যালার্জির উপসর্গ দেখা দেয়। অনেক সময় দেখা যায় বৃষ্টিতে ভিজলে, পুকুরে গোসল করলে, ধুলোবালিতে গেলে, ফুলের পরাগরেণু নাকের ভিতরে গেলে, একটু ঠান্ডা লাগলেই বা কোনো ঠান্ডা পানীয় পান করলে কারও কারও সর্দি-কাশি শুরু হয়ে যায়। যাকে সাধারণভাবে আমরা ঠান্ডা লাগা বলে চিনি।
সবারই কিন্তু এসবের সংস্পর্শে আসলে এরকম প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায় না। অর্থাৎ একই কাজগুলো অন্যরা করলে তাদের কিছুই হয় না। তাহলে এটা পরিষ্কার যে বৃষ্টির পানি, ধুলোবালি, পুকুরের পানি, ঠান্ডা পানি কিংবা পানীয় ইত্যাদি কারও জন্য অ্যালার্জেন হিসেবে কাজ করে, আবার কারও কারও জন্য এটা স্বাভাবিক আর দশটা পরিবেশের উপাদান হিসেবেই বিরাজ করে। অ্যালার্জি এবং তার প্রতিকার সম্পর্কে জানার আগে চলুন আমরা জেনে নেই অ্যালার্জি কি; অ্যালার্জি কত প্রকার ও কী কী?
অ্যালার্জি কি?
অ্যালার্জি হলো বডির ইমিউন সিস্টেমের একটি ওভার সেনসিটিভ বা অতিসংবেদনশীল দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা। এক্ষেত্রে পরিবেশে বিদ্যমান কোনো অ্যালার্জেনের কারণে শরীরে আনএক্সপেক্টেড ডিসটার্বিং রিয়্যাকশন দেখা যায়। অ্যালার্জি হওয়া কিংবা না হওয়া সাধারণত আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে।
শরীরের এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিনিয়ত পরিবেশের নানা উপাদান, যেমন- পরজীবী, ছত্রাক, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ইত্যাদির বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। এটা খুবই স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু কখনো কখনো স্বাভাবিক এই প্রক্রিয়াটিই জেনেটিক ত্রুটির কারণে অস্বাভাবিক, অতিসংবেদনশীল কিংবা অপ্রত্যাশিত হয়ে পড়ে, দেখা দেয় অ্যালার্জি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোনো কোনো ব্যক্তির শরীর আপাতদৃষ্টিতে ক্ষতিকর নয় এমন অনেক ধরনের বস্তুকেও ক্ষতিকর ভেবে প্রতিরোধের চেষ্টা করে। সাধারণত ক্ষতিকর নয় এমন সব বস্তুর প্রতি শরীরের অতিসংবেদনশীল প্রতিক্রিয়াকে অ্যালার্জি বলা হয়।
অ্যালার্জি কত প্রকার ও কী কী?
অ্যালার্জি বিভিন্ন ধরনের হতে পারে এটি নির্ভর করে, আপনার শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উপর। নিচে কিছু অ্যালার্জির ধরন এবং তার কারণ সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:
অ্যালার্জিক রাইনাইটিস
অ্যালার্জিক রাইনাইটিস হলে সাধারণত শ্বাসযন্ত্রের মিউকাস পর্দা আক্রান্ত হয় এবং হিস্টামিন নামক রাসায়নিকের প্রভাবে আক্রান্ত মিউকাস পর্দা থেকে প্রচুর পরিমাণ মিউকাস ক্ষরিত হয়। এছাড়া প্রদাহের কারণে শ্বাসযন্ত্রে লিউকোট্রিন নামক এক ধরনের জৈব-রাসায়নিক পদার্থ তৈরি হয় যা কাশি তৈরিতে শ্বাসযন্ত্রকে উদ্দীপ্ত করে। এজন্য নাক দিয়ে পানি পড়া তথা ঘন ঘন হাঁচি কিংবা সর্দি-কাশি, সঙ্গে প্রদাহজনিত কারণে শরীরে হালকা জ্বর থাকা, নাক চুলকানো, নাকে বন্ধভাব বোধ করা- এসব কিছুই অ্যালার্জি রাইনাইটিসের কারণে হয়ে থাকে।
অনেক সময় রাইনোভাইরাস নামক সর্দি-কাশি উৎপন্নকারী এক ধরনের ভাইরাসও অ্যালার্জেন হিসেবে কাজ করে। শীতকালের মতো বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে অ্যালার্জিক রাইনাইটিস হলে একে সিজনাল অ্যালার্জিক রাইনাইটিস বলা হয়। আর সারা বছর ধরে হলে একে পেরিনিয়াল অ্যালার্জিক রাইনাইটিস বলা হয়। এক্ষেত্রে লক্ষণসমূহ কম তীব্র হলেও এর স্থায়িত্ব হয় বেশি।
অ্যালার্জিক ডার্মাটাইটিস
মশা, ছারপোকা বা অন্য কোনো পতঙ্গ কামড় দিলে বা যদি এমন কোনো ধরনের বস্তুর সংস্পর্শে আসলে শরীরের ঐ অংশে যদি ফুলে লাল চাকা হয়ে প্রচন্ড চুলকানি তৈরি হয় (আর্টিকেরিয়া) তাহলে এ অবস্থাকে বলে অ্যালার্জিক ডার্মাটাইটিস। কোনো কোনো প্রসাধনী দ্রব্যও অনেকের শরীরে এ ধরনের অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে। সাধারণত স্বল্পস্থায়ী আর্টিকেরিয়া শিশুদের মধ্যে এবং দীর্ঘস্থায়ী আর্টিকেরিয়া বড়দের মধ্যে দেখা যায়।
ফুড অ্যালার্জি
অনেকের গরুর মাংস, ইলিশ মাছ, দুধ, হাঁসের ডিম, চীনাবাদামসহ বিভিন্ন ধরনের বাদাম, তিল, বেগুন, মাশরুম, খোলসযুক্ত মাছ যেমন- চিংড়ি, কাঁকড়া ইত্যাদি বা বাইরের কোনো খাবার খেলেই শরীরে চুলকানি শুরু হয়ে যায়, চামড়ায় লাল লাল গোটা ওঠে কিংবা বমি বমি ভাব হয়, এমনকি বমি বা ডায়রিয়াও হয়। এগুলো মূলত অ্যালার্জির কারণে হয়ে থাকে। একে বলা হয় ফুড অ্যালার্জি। ঐ সমস্ত ব্যক্তির শরীর এ সকল খাবারের জন্য উপযোগী নয়। এই খাবার অন্যদের জন্য স্বাভাবিক হলেও বিশেষ জেনেটিক গঠনের কারণে ঐ ব্যক্তিদের জন্য অ্যালার্জেন হিসেবে কাজ করে।
ড্রাগ অ্যালার্জি
কিছু মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তারা কোনো ধরনের ওষুধ বিশেষ করে অ্যান্টিবায়োটিক (পেনিসিলিন কিংবা সেফালোস্পোরিন) গ্রহণ করার পরে তাদের শরীরে চুলকানি হয়ে চামড়া লাল হয়ে যায়। কোনো ওষুধ ব্যবহারের ফলে যদি কোনো ধরনের অস্বাভাবিক অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া শুরু হয় তবে সেটিকে ড্রাগ অ্যালার্জি বলা হয়। যদি কারও এমন হয় তাহলে তাকে অ্যালার্জেন ওষুধ পরিবর্তন করে অন্য ধরনের ওষুধ সেবন করতে হবে।
এগুলো ছাড়াও আরও বেশ কিছু অ্যালার্জির ধরন রয়েছে।
অ্যালার্জি থেকে মুক্তির উপায়
অ্যালার্জি আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য মন খারাপের কথা হলো অ্যালার্জির স্থায়ী কোনো চিকিৎসা নেই। কারণ এটার সম্পর্ক শরীরের ইমিউন সিস্টেমের সাথে। এজন্য যাদের যেসব বস্তু বা খাবারে অ্যালার্জি রয়েছে তা এড়িয়ে চলাই ভালো। অ্যালার্জিতে যেহেতু শরীরে প্রচুর পরিমাণে হিস্টামিন ক্ষরিত হয়, তাই অ্যালার্জি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে অনিয়ন্ত্রিত হিস্টামিন ক্ষরণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আর সেজন্য অ্যালার্জিজনিত প্রতিক্রিয়া দেখা দিলে অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধই হলো অ্যালার্জির মূল চিকিৎসা। তবে সকল অ্যান্টিহিস্টামিন সকলের জন্য প্রযোজ্য নয়। বিশেষ ক্ষেত্রে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধও প্রয়োগের প্রয়োজন পড়ে।
আধুনিক ইমিউনোথেরাপির মাধ্যমেও বর্তমানে অ্যালার্জির চিকিৎসা করা হচ্ছে। সর্বোপরী অ্যালার্জির চিকিৎসায় চিকিৎসকের পরামর্শ ব্যতীত কোনো চিকিৎসা নেওয়া কিংবা হোমিওপ্যাথি বা কবিরাজির মতো বিকল্প ধারার চিকিৎসা গ্রহণ করা বিপজ্জনক হতে পারে। অ্যালার্জিজনিত কোনো শারীরিক সমস্যায় নিকটস্থ চিকিৎসক কিংবা সরাসরি হাসপাতালে যোগাযোগ করাই সবচেয়ে ভালো। কথায় আছে, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম। প্রতিকারের চেয়ে অ্যালার্জি প্রতিরোধই, অ্যালার্জিক সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রধান হাতিয়ার।