বর্তমানে রোবটিক্স শব্দটি সকলের সুপরিচিত। যদিও রোবট ও রোবটিক্স শব্দ দুটি একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত হলেও ভিন্ন অর্থ বহন করে। বিভিন্ন সাইন্স ফিকশন বই বা সিনেমায় রোবটিক্স নিয়ে সুবিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। কৌতুহলী মানুষের মনে রোবটিক্স নিয়ে আগ্রহ দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান মেলায় রোবট বানিয়ে সারা দেশের মানুষকে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে।
রোবটিক্স কি ?
রোবটিক্স হল বিজ্ঞান প্রযুক্তির এমন একটি শাখা যেখানে একটি রোবটের নির্মাণ পদ্ধতি, কার্যপদ্ধতি, ডিজাইন বা নকশা প্রণয়ন, পরিচালনা প্রক্রিয়া ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করার হয়। রোবটিক্সের জনক বলা হয় জর্জ ডেবলকে।
আমরা অনেকেই রোবট সম্পর্কে শব্দটির সাথে পরিচিত। হলিউড ও বলিউডে রোবট নিয়ে ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি ব্লকবাস্টার সিনেমা রিলিজ পেয়েছে। রোবট বলতে বুঝি আমরা যন্ত্রমানব। ঠিক করে বলতে গেলে, প্রযুক্তির সাহায্যে নির্মিত মানুষের আকৃতির এক ধরনের যন্ত্র যা মানুষের কাজকর্ম প্রায় হুবহু নকল করতে পারে, সেটিই হচ্ছে রোবট। তবে রোবট যে মানুষের মতো দেখতে হবে ভাইয়ের আকার-আকৃতিতে মানুষের মতোই হবে তা নয় কাজের সুবিধার্থে রোবটের আকার ও আকৃতি ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। রোবট শব্দটি মূলত একটি গ্রিক শব্দ যার অর্থ শ্রমিক।
বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় রোবট নিয়ে গবেষণা হচ্ছে। এমনকি রোবট নিয়ে পড়াশোনার একটি শাখাও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খোলা হয়েছে। এই বিষয়টির নাম হচ্ছে রোবটিক্স। বাংলাদেশেও রোবটিক্স নিয়ে পড়ালেখার সুযোগ রয়েছে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রোবটিক্স নিয়ে পড়ার সাবজেক্ট রয়েছে। এই সাবজেক্টে পড়তে হলে একজন শিক্ষার্থীকে বিজ্ঞান বিভাগের থেকে উচ্চ মাধ্যমিকে উত্তীর্ণ হতে হবে এবং ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে এই সাবজেক্টে পড়ার যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।
রোবট অলিম্পিয়াড
গণিত, রসায়ন, জ্যোতির্বিদ্যা বা জীববিজ্ঞান অলিম্পিয়াডের মত বিশ্বব্যাপী একটি রোবট অলিম্পিয়াড প্রতিবছর অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। সেখানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ক্ষুদে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করার সুযোগ পায়। বাংলাদেশেও বাংলাদেশ রোবট অলিম্পিয়াড নামে একটি প্রতিযোগিতা প্রতিবছর আয়োজন করা হচ্ছে। এই প্রতিযোগিতায় ক্ষুদে রোবট নির্মাতারা বিশ্ব রোবট অলিম্পিয়াডে বাংলাদেশের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পায়। এছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ও রোবটিক্স নিয়ে ছোটখাটো কর্মশালা আয়োজন করে থাকে। এ সকল আয়োজন করার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে তরুণ সমাজের মাঝে রোবটিক্সের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি ও ভবিষ্যতে রোবটিক্সের সম্ভাবনাময়তা সবার কাছে তুলে ধরা।
রোবটিক্সের ক্ষেত্র
বর্তমানে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার সমহারে বাড়ছে। প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে এখন উৎপাদনশীল কোম্পানিগুলো তাদের উৎপাদন ক্ষমতা বহু গুণ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। নির্মাণ কাজ হয়েছে পূর্বের চেয়ে আরো নিখুঁত এবং নিরাপদ। এর পেছনে মূল কারণ হচ্ছে রোবটিক মানুষের পরিবর্তে রোবট ব্যবহার করার কারণে কাজগুলো খুব নিখুঁত করা সম্ভব হচ্ছে। এছাড়া বিপদজনক কাজগুলোতে রোবট ব্যবহার করার কড়াই প্রাণহানির সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এছাড়া রোবটগুলো অত্যন্ত দক্ষ ও দ্রুত হওয়ায় উৎপাদন ক্ষমতা মানুষের চেয়ে অনেক বেশি। যার ফলে বড় বড় কোম্পানিগুলো শ্রমিকের পরিবর্তে রোবটের ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে।
বিভিন্ন কোম্পানিগুলোর রোবটের প্রতি নির্ভরশীল পাওয়ার কারণে রোবট নির্মাতাদের চাহিদা বেড়েই চলেছে। যার ফলাফল রোবটিক্স অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কোন কোন ক্ষেত্রে রোবটক্সের ব্যবহার করা হয়? সত্যি বলতে কি, বর্তমানে প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই রোবটিক্সের ব্যবহার করা হচ্ছে। একটি গাড়ি নির্মাণ করা থেকে পটেটো চিপসের প্যাকেট মুখ বন্ধ করা পর্যন্ত সব ক্ষেত্রেই রোবটের ব্যবহার করা হয়।
রোবটিক্সের ব্যবহার
১. অটোমোবাইল শিল্পে
বর্তমানে বিভিন্ন গাড়ি নির্মাতারা রোবটের উপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল। একটি গাড়ি নির্মাণে প্রত্যেকটি কার্যকলাপ এখন স্বয়ংক্রিয় রোবটের মাধ্যমে করা হচ্ছে। ছোট ছোট পার্টস থেকে টায়ার পর্যন্ত লাগানোর কাজে রোবটের ব্যবহার করা হয়। অটোমোবাইল শিল্পের রোবটের ব্যবহার এই শিল্পটিকে আরো উৎপাদনশীল ও নিরাপদ করে তুলেছে। পূর্বে অনেক শ্রমিক কাজ করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে আহত হতো, কিন্তু এখন রোবট ব্যবহার করার কারণে মানুষের আঘাত পাওয়ার সম্ভাবনা একদমই নেই।
২. চিকিৎসা ক্ষেত্রে
শুনতে অবাক লাগলেও বিভিন্ন রোগের সার্জারিতে এখন রোবট ব্যবহার করা হচ্ছে। রোবট ব্যবহার করার ফলে অত্যন্ত জটিল জটিল সার্জারিগুলো নিখুঁতভাবে পরিচালনা করা সম্ভব। উন্নত বিশ্বে বিভিন্ন চিকিৎসায় রোবটের ব্যবহার অহরহ। বাংলাদেশে খুব শীঘ্রই রোবটের মাধ্যমে সার্জারি করা হবে বলে বিভিন্ন মেডিকেল হাসপাতাল আশাবাদী। চিকিৎসা ক্ষেত্রে রোবট ব্যবহার করা হলে চিকিৎসা ব্যয় পূর্বের চেয়ে অনেক কমে আসবে।
৩. মহাকাশ গবেষণা ক্ষেত্রে
যারা মহাকাশ নিয়ে আগ্রহ রাখেন তারা নিশ্চয়ই জানেন যে নাসা এবং অন্যান্য মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে চাঁদ ও মঙ্গল গ্রহে রোবট পাঠিয়েছে, যা সাধারণত ল্যান্ড রোভার নামে পরিচিত। এই রোবটগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে পৃথিবীর বাহিরে নিজেদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে এবং বিভিন্ন ডাটা পৃথিবীতে পাঠাচ্ছে। এই ডাটাগুলো এনালাইসিস করে বিজ্ঞানীরা উক্ত গ্রহ ও উপগ্রহের উপাদান, কাঠামো ও অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পাচ্ছে। এমন অসম্ভব কাজ সম্ভব হয়েছে শুধুমাত্র রোবটিক্সের কল্যাণে।
৪. সামরিক কাজে
বর্তমানে বিভিন্ন দেশের সামরিক বাহিনীতে সৈনিক হিসেবে মানুষ কাজ করেন। যখন কোনো দুটি দেশের মধ্যে যুদ্ধ লাগে তখন শত শত এমনকি হাজার হাজার সৈনিকের মৃত্যুর খবর শোনা যায়। এছাড়া আহতও হয় প্রচুর। কিন্তু ভবিষ্যতে বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনী সৈনিক হিসেবে রোবট নিয়োগ দিতে চলেছে। এই রোবটগুলো একজন মানুষের চেয়ে সক্ষমতায় মানুষের চেয়ে শক্তিশালী। এর ফলে হাজারো মানুষের প্রাণ বাঁচবে। এই রোবট সৈনিকগুলো বিভিন্ন বিপদজনক কাজে অংশ নিতে পারবে। কোনো কারণে যদি বিস্ফোরণের রোবটগুলোর ধ্বংস হয়ে যায় সেক্ষেত্রে কোনো মানুষের মূল্যবান প্রাণহানি হচ্ছে না। সন্ত্রাস দমনে রোবটের ব্যবহারে বিজ্ঞানীরা তাগাদা দিচ্ছেন।
৫. বিপদজনক কাজে
বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেকটি দেশেই শিল্পনির্ভর শিল্পনির্ভর। একটি শিল্প ব্যবস্থায় অনেক বিপদজনক যন্ত্র পরিচালনা করতে হয়। এই যন্ত্র পরিচালনা করতে গিয়ে হরহামেশাই মানুষ আহত হচ্ছে, কখনো কখনো তো নিহতের খবর শোনা যায়! কিন্তু শিল্পক্ষেত্রে যদি রোবটের ব্যবহার বৃদ্ধি করে দেওয়া যায় সেক্ষেত্রে মানুষের প্রাণহানি শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসা সম্ভব। এছাড়া পৃথিবীর জনসংখ্যা দ্রুত হারে বাড়ছে। তাই সকল মানুষের চাহিদা পূরণ করতে হলে আমাদের শিল্পকে আরো উৎপাদনশীল হতে হবে। আর এটি সম্ভব একমাত্র রোবটের ব্যবহারের ফলে।
৬. ঘরোয়া কাজে
আমাদের বিভিন্ন ঘরোয়া কাজেও রোবটের ব্যবহার করা যাবে। যেমন ঘরবাড়ি পরিষ্কার রাখা, বাগানের ঘাসগুলো কাটা, দরজা ও জানালা খুলে দেওয়া বা বন্ধ করা, খাবার তৈরি করা, কাপড় ধোঁয়া ও ইস্ত্রি করা ইত্যাদি কাজে রোবটের ব্যবহার উন্নত বিশ্বে লক্ষ্য করা যায়। অতি শীঘ্রই সাধারণ জনগণের কাছে ঘরোয়া কাজে ব্যবহারযোগ্য রোবট সহজলভ্য হয়ে উঠবে।
৭. পরিবহন কাজে
ইতিমধ্যে বিভিন্ন বিজ্ঞানীরা রোবট ড্রোন সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। এই ড্রোনগুলো মূলত পরিবহন কাজে ব্যবহার করা হবে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে আমরা খুব সহজেই ড্রোনের মাধ্যমে আমাদের মূল্যবান বস্তু বা খাবার আরেকজনের কাছে পৌঁছাতে সক্ষম হবো। মূলত কুরিয়ার সার্ভিস ব্যবস্থাকে রোবটিকরণ করাই এই ড্রোনগুলো মূল উদ্দেশ্য। কুরিয়ার সার্ভিসে রোবটের ব্যবহার এই সেক্টরটিকে আরো দ্রুত সস্তা ও গ্রাহকের কাছে নির্ভরযোগ্য করে তুলবে। উবার ইটস ইতিমধ্যে তাদের পরিবহন সেক্টরের ড্রোনের ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে এমনকি অ্যামাজন ও তাদের প্রোডাক্ট ডেলিভারিতে ড্রোন ব্যবহার করার চিন্তা ভাবনা করছে।
সাইন্স ফিকশন বই ও সিনেমাগুলোতে রোবটের সাধারণত নেতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরা হয়। যেমন রোবট মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে মানুষের বিরুদ্ধে এই কাজ করতে পারে। এছাড়া রোবটের ব্যবহারের ফলে শিল্পক্ষেত্রে অসংখ্য শ্রমিক তাদের চাকরি হারিয়েছে। ফলে তার কর্মহীন হয়ে গেছে এবং বেকার জীবন যাপন করছে। তাদের ভবিষ্যৎও এখন অনিশ্চিত। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে রোবট ব্যবহারের ফলে মানুষের জীবনযাত্রার মান আগের চেয়ে বহুলাংশে পরিবর্তিত হবে। রোবটের ব্যবহারের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় পণ্যের বিনিময় মূল্য অনেকাংশে কমে যাবে। তখন স্বল্পআয়ের মানুষ ও তাদের নিজের চাহিদা গুলো সহজে পূরণ করতে সক্ষম হবে। রোবটিক্সের সুষ্ঠু ব্যবহারই নিশ্চিত করবে আমাদের উন্নত ভবিষ্যৎ।