হ্যাকিং সম্পর্কে আমরা কম বেশি সবাই অবগত। হ্যাকিং শব্দটি শুনলেই আমাদের মনেই প্রথমে একটি নেতিবাচক ধারণা জন্ম নেয়। আমরা যারা অনলাইনে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয়, তারা হয় হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছেন অথবা অন্যদের হ্যাকিংয়ের শিকার হতে দেখেছেন হ্যাকিং বলতে আমরা বুঝি সীমাহীন বিরম্বনা ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়া। কিন্তু আপনার কি কখনো ইথিক্যাল হ্যাকিং সম্পর্কে শুনেছেন? জেনেছেন ইথিক্যাল হ্যাকিং কি? এটা কি আমাদের জন্য আদৌ ভালো, নাকি খারাপ কিছু? কিভাবে ইথিক্যাল হ্যাকিং করে অনেক ফ্রিল্যান্সার মাসে হাজার হাজার ডলার কামাচ্ছে? আসুন উত্তরগুলো জেনে নেই।
হ্যাকিং কি?
সহজ ভাষায়, হ্যাকিং বলতে আমরা বুঝি মালিকের অনুমতি ব্যতীত কোন ওয়েবসাইটে অনধিকার প্রবেশ। যারা হ্যাকিং করে, তাদের বলা হয় হ্যাকার। হ্যাকাররা সাধারণত কোন ওয়েবসাইটে থাকা ত্রুটিগুলো খুজে বের করে অন্যায়ভাবে ওয়েবসাইটটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ফলে হ্যাকার ইচ্ছামত ওয়েবসাইটটি পরিচালনা করতে পারে বা সাইট ডাউন করে দিতে পারে।
ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ের নানারকম খবর আমরা নিয়মিতই শুনতে পাই। বিভিন্ন নামিদামি প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট হরহামেশাই হ্যাক হচ্ছে। গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যাপেল থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশের সরকারি ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এসব হ্যাকিংয়ের মূল উদ্দেশ্য সাইটের ক্ষতিসাধন হয়ে থাকে। তবে আপনি শুনে অবাক হবেন যে, বর্তমানে অনেক হ্যাকার ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে হ্যাকিং করে থাকে। এমনকি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজেদের ওয়েবসাইট হ্যাক করার জন্য দক্ষ হ্যাকারদের নিয়োগ দিয়ে থাকে। তাদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রতিষ্ঠান ওয়েবসাইটে ত্রুটি গুলো খুজে বের করা।
হ্যাকারদের প্রকারভেদ
সার্বিক দিক দিয়ে আমরা হ্যাকারদের তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। যথা–
- ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার
- গ্রে হ্যাট হ্যাকার
- হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার
ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার: এসব হ্যাকারদের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সাইটের ক্ষতি সাধন অথবা সাইট পুরোপুরি ডাউন করে দেওয়া। ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকারদের কবলে আমরা কমবেশি পড়ে যাই অথবা অন্যদের পড়তে দেখি। এরা সাইট হ্যাক করে অনেক সময়ে সাইটের মালিকদের কাছে অর্থ দাবি করে। অর্থ পরিশোধ করা সাপেক্ষে তারা সাইটটি পুনরায় ঠিক করে দেবে, এই মর্মে অনেক ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকার অনৈতিক পন্থায় অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। অর্থ পরিশোধ না করলে তারা সাইটের সকল ডাটাবেজ মুছে ধ্বংস করে দেয়। ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকারদের অনেক সময় ক্র্যাকার্স বলা হয়।
গ্রে হ্যাট হ্যাকার: এসব হ্যাকারদেরকে ভালো ও খারাপ দুটোই বলা যায়। তারা শুরুতে ওয়েবসাইটের মালিকের অনুমতি ব্যতীত ওয়েবসাইট হ্যাক করে থাকে। পরবর্তীতে ওয়েবসাইটের ত্রুটিগুলো ওয়েবসাইটের মালিককে জানিয়ে দেয় এবং কিছু পারিশ্রমিক দাবি করে। এসব হ্যাকাররা কখনোই সাইটের বড় রকম ক্ষতিসাধন করে না। কিন্তু নিজেদের স্বার্থকে সব সময় উপরে রাখে। তবে গ্রে হ্যাট হ্যাকারদের কারণে অনেক সময় ওয়েবসাইটগুলো অন্যরকম হ্যাকিংয়ের শিকার হতে রক্ষা পায়।
হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার: যে সকল হ্যাকার ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে ওয়েবসাইট হ্যাক করে থাকে তাদের বলা হয় হোয়াইট হ্যাট হ্যাকার। এই সকল হ্যাকারদের উদ্দেশ্য কখনো খারাপ হয় না, বরং হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে ওয়েবসাইট মালিকদেরর বড় রকম ক্ষতি থেকে বাঁচানো হোয়াইট হ্যাট হ্যাকারদের মূল উদ্দেশ্য হয়ে থাকে। তারা কখনো টাকার বিনিময় কাজ করে না, কিন্তু অনেক সময়ে বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মালিকেরা হোয়াইট হ্যাট হ্যাকারদের নিয়োগ করে থাকে নিজেদের ওয়েবসাইটটিকেই হ্যাক করার জন্য। এটি মূলত করা হয় সাইটের নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য এবং সাইটের ত্রুটিগুলো বের করে ঠিক করার জন্য। হোয়াইট হ্যাট হ্যাকারদের কারণে বড় বড় ওয়েবসাইট হ্যাকিংয়ের শিকার থেকে রক্ষা পাচ্ছে।
ইথিক্যাল হ্যাকিং কি ?
ইথিক্যাল ইংরেজি শব্দের বাংলা অর্থ হচ্ছে “নৈতিক”। ইথিক্যাল হ্যাকিং বলতে বুঝায় যে সব হ্যাকিং অনৈতিক নয় বা যে সব হ্যাকিং ওয়েবসাইটের ক্ষতির উদ্দেশ্যে করা হয় না। হোয়াইট হ্যাট হ্যাকারদের করা হয় মূলত হ্যাকিংয়ের আওতায় পড়ে।
তাহলে ইথিক্যাল হ্যাকিংয়ের উদ্দেশ্য কি? একটি ওয়েবসাইট নির্মাণ করা একটি ব্যয়বহুল ও সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। একটি ওয়েবসাইটের মধ্যে ছোট ছোট অসংখ্য ত্রুটি থাকতে পারে। এই ত্রুটিগুলো কাজে লাগিয়ে অনেক সময় ব্ল্যাক হ্যাট হ্যাকাররা ওয়েবসাইটের এক্সেস পেয়ে যায় এবং নানা রকম ক্ষতি সাধন করতে পারে।
ওয়েবসাইটের ত্রুটিগুলো খুঁজে বের করাই ইথিক্যাল হ্যাকিংয়ের মূল উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে ওয়েবসাইট নির্মাতারা অনেক সময় কিছু ইথিক্যাল হ্যাকারদের নিয়োগ দিয়ে থাকেন। তাদের মূল কাজ হয়ে থাকে ওয়েবসাইট থেকে ভুল ত্রুটি খুঁজে বের করা। যখন একজন ইথিক্যাল হ্যাকার কোনো বাগ(bug) খুঁজে পান তখন সেটি ওয়েবসাইটের মালিকদের জানিয়ে দেন। ওয়েবসাইট মালিকরা সেই বাগ বা ত্রুটিগুলো সংশোধন করে নেন। ফলে একটি ওয়েবসাইট বড় রকম হ্যাকিংয়ের শিকার হতে রক্ষা পায়। এছাড়া একটি ওয়েবসাইটের উন্নতি সাধনের জন্য ইথিক্যাল হ্যাকারদের নিয়োগ করা হয়।
ইথিক্যাল হ্যাকিংয়ের প্রয়োজনীয়তা
- মানুষ ভুলের উর্ধে নয়। ঠিক তেমনই একজন ওয়েব ডেভেলপারের ওয়েবসাইট নির্মাণের সময় কিছু ভুলত্রুটি হতে পারে। সে ভুল ত্রুটির কারণে ওয়েবসাইটটি পরিচালনায় অসংখ্য বাধার সম্মুখীন হতে হয়। আর এই ভুলগুলো খুঁজে বের করাই ইথিক্যাল হ্যাকারের কাজ।
- অনেক অসাধু হ্যাকার নিয়মিতই বিভিন্ন ওয়েবসাইট হ্যাক করে যাচ্ছে। তাই নিজের ওয়েবসাইটটিকে হ্যাকার মুক্ত রাখতে হলে ওয়েবসাইটের সকল ত্রুটিগুলো যথাসম্ভব ফিক্স করতে হবে। কিন্তু আমাদের অনেকেই ত্রুটিগুলো খুঁজে পেতে কতটা দক্ষ নয়। এক্ষেত্রে ইথিক্যাল হ্যাকাররাই আমাদের বেস্ট চয়েস।
- ওয়েবসাইটে বাগের(bug) পরিমাণ বেশি হলে গ্রাহকেরা ঠিকমতো সেবা পায় না। গ্রাহকের অসন্তুষ্টি ওয়েবসাইট মালিকের বড় রকম আর্থিক ক্ষতি করে ফেলতে পারে। তাই বাগগুলো খুঁজে পেতে একজন ইথিক্যাল হ্যাকারকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
- হ্যাকিংয়ের শিকার না হয়েও অনেক সময় ওয়েবসাইট ডাউন হয়ে যেতে পারে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে ওয়েবসাইট নির্মাণে ত্রুটি। একজন দক্ষ ইথিক্যাল হ্যাকার ছাড়া এই ত্রুটিগুলো অনেক সময় খুঁজে পাওয়াই যায় না।
- ওয়েবসাইটে এমন সব ডাটা থাকে যেগুলো ব্যবহার করে অপরপক্ষ নিজেদের অনৈতিকভাবে লাভবান করতে পারে। তার জন্য অনৈতিকভাবে হ্যাকিংয়ের আশ্রয় নিতে পারে অসাধু মহল। আর তাই ওয়েবসাইটের সকল ডাটা রক্ষার জন্য ইথিক্যাল হ্যাকারের সাগায্য নেওয়া হয়।
ইথিক্যাল হ্যাকিং করে আয়
জি ঠিক শুনেছেন, ইথিক্যাল হাকিং করেও আয় করা সম্ভব। ইথিক্যাল হ্যাকিং বর্তমানে অন্যতম হিসেবে গড়ে উঠেছে। বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সিং মার্কেটপ্লেস, যেমন ফ্রিল্যান্সার, ফাইবার, আপওয়ার্ক ইত্যাদিতে নিয়মিত ইথিক্যাল হ্যাকার নিয়োগের পোস্ট করা হচ্ছে। শুরুর দিকে একজন ইথিক্যাল হ্যাকারকে ওয়েবসাইটগুলো ঘণ্টায় ৫০ থেকে ১০০ ডলার দিয়ে থাকে। কিন্তু একজন দক্ষ প্রতি ঘন্টায় কাজ করার জন্য ২০০ থেকে ৫০০ ডলার নিয়ে থাকেন।
আপনিও কি ইথিক্যাল হ্যাকিং করে আয় করতে চাইছেন? কোথায় শিখবেন ইথিক্যাল হ্যাকিং? মজার ব্যাপার হল, আপনি চাইলে অনলাইন থেকে ইথিক্যাল হ্যাকিং শিখতে পারেন। ইথিক্যাল হ্যাকিংয়ের অনেকগুলো কোর্স অনলাইনে চালু আছে। এছাড়া বিভিন্ন ওয়েবসাইট শুধুমাত্র ইথিক্যাল হ্যাকিং নিয়ে আপডেট দিয়ে থাকে। বিভিন্ন ই-বুক ও ইউটিউবে ভিডিও প্লে লিস্ট রয়েছে শুধুমাত্র ইথিক্যাল হ্যাকিং শেখার জন্য। বাংলাদেশের অনেকেই ইথিক্যাল হ্যাকিং করে নিজেদের ক্যারিয়ার গঠন করেছেন এবং ইথিক্যাল হ্যাকিং করে হাজার হাজার ডলার আয় করছেন।
বর্তমান সময়ে অনেক ফ্রিল্যান্সার ইথিক্যাল হ্যাকিংয়ের উপর ঝুঁকছেন। বড় বড় কোম্পানিগুলো ইথিক্যাল হ্যাকারদের সমীহ করে থাকেন। যেমন গুগল অনেক সময় ইথিক্যাল হ্যাকারদের নিজেদের প্রতিষ্ঠানে চাকরি দিয়ে থাকে। অনেকেই শখের বশে গুগলের কান্ট্রি ডোমেইনগুলো হ্যাক করে। মূলত গুগলের ওয়েবসাইটে থাকা ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করে দেওয়াই সেই সকল ইথিক্যাল হ্যাকারদের উদ্দেশ্য। এরফলে গুগল খুশি হয়েই ইথিক্যাল হ্যাকারদের পুরস্কৃত করে থাকে। ইথিক্যাল হ্যাকারদের এসব গল্প আপনারা সোশ্যাল মিডিয়াতে শুনে থাকবেন। ইথিক্যাল হ্যাকিং নতুন কোনো বিষয় নয়, বরং এই সেক্টরটি ভবিষ্যতে আরো বড় হতে চলেছে। এখন আপনার কাছেও সুযোগ রয়েছে এই সেক্টরের অংশীদার হওয়ার।