মুন্সীগঞ্জ ঐতিহাসিকভাবে বিক্রমপুর নামেও পরিচিত, মধ্য বাংলাদেশের একটি জেলা। এটি ঢাকা বিভাগের একটি অংশ এবং ঢাকা জেলার সীমান্তবর্তী। মুন্সীগঞ্জ জেলার আয়তন ৯৫৪.৯৬ বর্গ কিমি। এর বৃহত্তম থানা- শ্রীনগর (২০৩ বর্গ কিমি), ক্ষুদ্রতম থানা- লৌহজং (১৩০ বর্গ কিমি)। মুন্সীগঞ্জ জেলার উত্তরে ও উত্তর পশ্চিমে ঢাকা জেলা,উত্তর-পূর্বে নারায়ণগঞ্জ জেলা, দক্ষিণে মাদারীপুর জেলা, শরীয়তপুর জেলা ও পদ্মা নদী, পূর্বে মেঘনা নদী ও কুমিল্লা জেলা, পূর্ব দক্ষিণ দিকে চাঁদপুর জেলা এবং পশ্চিমে পদ্মা নদী, ঢাকা ও ফরিদপুর জেলার অংশবিশেষ অবস্থিত।
মোঘল শাসনামলে মুন্সীগঞ্জ এর নাম ছিলো ইদ্রাকপুর। ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ইদ্রাকপুর কেল্লার ফৌজদারের নাম ছিলো ইদ্রাক। ধারণা করা হয় তার নাম অনুসারেই তখন এখানকার নাম হয়েছিলো ইদ্রাকপুর। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময়ে রামপালের কাজী কসবা গ্রামের মুন্সী এনায়েত আলীর জমিদারভুক্ত হওয়ার পর তার মুন্সী নাম থেকে ইদ্রাকপুরের নাম মুন্সীগঞ্জ হিসেবে অভিহিত হয়।
মুন্সীগঞ্জ জেলার ১০টি দর্শনীয় স্থান:
১. ইদ্রাকপুর দুর্গ
২. বাবা আদম মসজিদ
৩. শ্যামসিদ্ধি মথ বা মন্দির
৪. সোনারং টুইন মন্দির
৫. শান্তি বাবুর মথ বা মন্দির
৬. ফেগুনাসার শিব মন্দির
৭. বিক্রমপুর জাদুঘর
৮. স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু বাড়ি
৯. মন্ডল বাড়ি
১০. বারো আউলিয়ার মাজার।
মুন্সীগঞ্জ এর দর্শনীয় স্থান:
১. ইদ্রাকপুর দুর্গ
মুন্সীগঞ্জের কাছেই ইদ্রাকপুর দুর্গ যা ইদ্রাকপুর কেল্লা নামেও পরিচিত। ১৬৬০ সালে তৎকালীন বাংলার গভর্নর দ্বিতীয় মীর জুমলা এই দুর্গ নির্মাণ করেন। মুঘল সম্রাটের বাঙালি সেনাপতি মীর জুমলা ছিলেন একজন ভীতু ব্যক্তি। যে কারণে এই দুর্গটি অসম্পূর্ন হয়ে আছে। মগ ও পর্তুগিজ জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য এই দুর্গটি নির্মিত হয়েছিল। ছোট এই দুর্গটি ঘুরে দেখতে বেশি সময় লাগবে না।
২. বাবা আদম মসজিদ
মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলার কোশবা গ্রামে অবস্থিত বাবা আদম মসজিদটি এলাকার একটি অতিরিক্ত আকর্ষণ। ১৪৮৩ সালে এই প্রত্নতাত্ত্বিক মসজিদের নির্মাণ কাজ দেখে। এই মসজিদের আয়তন ১০ মিটার বাই ৩.৭৫ মিটার। ১১৭৩ খ্রিস্টাব্দে হযরত বাবা আদম শহীদ (র.) ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য এ অঞ্চলে আসেন। তিনি ১১৭৮ সালে শহীদ হন। সিপাহী পাড়া গ্রামে তার সমাধিস্থল।
৩. শ্যামসিদ্ধি মথ বা মন্দির
শ্যামসিদ্ধি মথ বা মন্দির আশেপাশে আরেকটি উল্লেখযোগ্য স্থান। শম্ভু নাথের ব্যাশার্থো মথ শ্যামসিদ্ধির পতঙ্গের অপর নাম। মন্দিরটি ১৭৫৮ সালে শম্ভু নাথ নামে একজন ধনী হিন্দু দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। অন্যান্য মন্দিরের মতো এটি স্থানীয় পর্যটকদের কাছে বিশেষ জনপ্রিয় হয়। ১৭৫৮ সালে এই অঞ্চলের একজন ধনী হিন্দু এই ১০০ ফুট লম্বা মথটি তৈরি করেছিলেন। শ্যামসিদ্ধি শ্রীনগর উপজেলায় অবস্থিত।
৪. সোনারং টুইন মন্দির
টঙ্গীবাড়ীর সোনারং গ্রামে সোনারং জোড়া মন্দির রয়েছে। দুটি দৃষ্টিনন্দন অথচ প্রাচীন মন্দিরের সান্নিধ্যের কারণে এলাকাটি স্থানীয়দের কাছে সোনারং জোড় মথ নামে পরিচিত। এই মন্দিরগুলি ১০০ থেকে ১৫০ ফুট লম্বা। নির্মাণের বছর বা স্থপতির নামও জানা যায়নি। মন্দিরের ঠিক সামনেই বিশাল জলরাশি।
৫. শান্তি বাবুর মথ বা মন্দির
সিরাজদিখান থেকে তাজপুরে (দক্ষিণ) শান্তি বাবুর বারির মঠ অবস্থিত। এই মথটি প্রায় এক শতাব্দী আগে স্থাপন করা হয়েছিল। কাঠামোর সামনে একটি বড় পুকুর রয়েছে। সিরাজদিখান বাজার থেকে মঠে যেতে বেশি সময় লাগবে না। এই মথটি কানকাটা দে মথ (কানকাটা মানে কান ছাড়া) নামেও পরিচিত। জনাব শান্তি রঞ্জন বাবুর জন্ম মাত্র একটি কান ছিল, যা দুর্ঘটনাবশত অপসারণ করা হয়েছিল। আশেপাশের লোকেরা মনে করত জলে বসবাসকারী দৈত্যের সাথে লড়াইয়ে তিনি একটি কান হারিয়েছিলেন।
৬. ফেগুনাসার শিব মন্দির
সিরাজদিখান হয়ে ইসামতি নদী পার হওয়ার পর ঢাকা-বেতকা (সিরাজদিখান) মহাসড়কের বাম পাশে একটি হিন্দু পতঙ্গ দেখা যায়। ফেগনাসার মথ একটি শিব মন্দির। এটি ১৫০ ফুট লম্বা এবং রাস্তা থেকে দেখা যায়। মথের ভিতরে একটি শিব লিঙ্গ রয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই এখানে ভক্তরা প্রার্থনা করতে আসেন। এটি অন্যান্য হিন্দু পতঙ্গের মতো একটি চমৎকার প্রাচীর গঠন রয়েছে। পুরো এলাকা এবং আশেপাশের এলাকা ফুলের বাগান বিশেষ করে জোবা (চীনা গোলাপ) দিয়ে সাজানো। তুলসি এবং জুঁই গাছও চাষ করা হয়।
৭. বিক্রমপুর জাদুঘর
জোগুনাথ বাবুর দেশান্তরিত হওয়ার পর সরকার তাঁর জমির এক টুকরো নিয়ে যাদুঘরে পরিণত করে। এটি এখন সপ্তাহে ছয় দিন খোলা থাকে বৃহস্পতিবার ছাড়া যা সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ২০১৩ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এটি উদ্বোধন করেন।
৮. স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু বাড়ি
রাড়িখাল ঢাকা-দোহার হাইওয়ে, শ্রীনগর, মুন্সীগঞ্জে স্যার জেসি বোস কমপ্লেক্সের বাড়ি। স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ছিলেন একজন বাঙালি পলিম্যাথ, পদার্থবিদ, জীববিজ্ঞানী, উদ্ভিদবিদ, প্রত্নতাত্ত্বিক এবং প্রাথমিক বিজ্ঞান কথাসাহিত্যিক যিনি ৩০ নভেম্বর ১৮৫৮ থেকে ২৩ নভেম্বর ১৯৩৭ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। তিনি রেডিও এবং মাইক্রোওয়েভ অপটিক্সের অধ্যয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন, উদ্ভিদ বিজ্ঞানে যথেষ্ট অবদান রাখেন এবং ভারতীয় উপমহাদেশে পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করেন। তাকে মাঝে মাঝে বাংলা কল্পবিজ্ঞানের জনক বলা হয়।
৯. মন্ডল বাড়ি
মন্ডল বাড়ি টঙ্গীবাড়ীর আব্দুল্লাপুরে পুলঘাটা ব্রীজ এবং দাওবাড়ীর পাশে অবস্থিত একটি ৩০০ বছরের পুরানো বাড়ি। এটি মুন্সীগঞ্জ জেলার একটি ঐতিহাসিক ভবন যা একটি ক্লাসিক জমিদার বাড়ির অনুরূপ। এর স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যগুলি মুন্সীগঞ্জ জেলার অন্যান্য বণিকদের বাড়ির মতো যেমন দাওবাড়ি, টোকানি পালের বাড়ি, চোরন পোদ্দারের বাড়ি, মাকাহাটির পুরানো বাড়ি, কামিনী পালের বাড়ি ইত্যাদির মতো। এই প্রাসাদ-সাদৃশ বাড়িগুলি সাম্প্রতিক সময়ে নির্মিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই দুর্গের অধিকাংশ মালিক ছিলেন ব্যবসায়ী।
১০. বারো আউলিয়ার মাজার
মুন্সীগঞ্জ জেলার অন্তর্গত বোরো কেওড় গ্রামে অবস্থিত “তেতুল টোলার মাজার” যা “বারো আউলিয়ার মাজার” নামেও পরিচিত, এটি বিক্রমপুরের প্রাচীনতম মুসলিম নিদর্শন। আদিকাল থেকেই এটি একটি পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। প্রতিটিতে প্রায় ১২টি কবরের দুটি সারি ছিল। মিলাদ, জিকির এবং পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত অতীতে মুসলমানদের দ্বারা এখানে সম্পাদিত আচারের মধ্যে ছিল। ১৯৭৪ সালে মাজারের একটি বড় সংস্কার করা হয়। সংস্কার কাজের সময় একটি পাথরের সন্ধান পাওয়া যায়। পাথরটিতে ১২ জন মুসলিম ধর্মগুরুর নাম খোদাই করা ছিল। এছাড়াও পাথরটি “কালেমা তাইয়েবা” এবং “হিজরি ৪২১” দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছিল যা নির্দেশ করে যে পাথরের শিলালিপিটি ৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে লেখা হয়েছিল।
বারো আউলিয়াদের নাম:
১) শাহ সুলতান হোসেন (র.)
২) সুলতান সাব্বির হোসেন (র.)
৩) তাকবীর হাশেমী (রাঃ)
৪) হাফেজ আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)
৫) হযরত ইয়াসিন (রাঃ)
৬) আল হাসান (রাঃ)
৭) শেখ হোসেন (র.)
৮) আবুল হাশেম হোসেন (রাঃ)
৯) ওবায়েদ ইবনে মুসলিম (রাঃ)
১০) হযরত আব্দুল হালিম (র.)
১১) হযরত শাহাদাত হোসেন (রাঃ)
১২) হযরত আব্দুল কাহার আল বাগদাদী (রাঃ)