- শবে বরাতের ফজিলত ও আমল
ওয়াহিদ আমিম
শবে বরাত শব্দটি ফারসি। এর আরবি প্রতিশব্দ হলো লাইলাতুল বারাআত। আরবি লায়লাতুন শব্দের অর্থ রাত। আর বারাআত অর্থ মুক্তি, নাজাত, নিষ্কৃতি ইত্যাদি। এ হিসেবে লাইলাতুল বারাআত অর্থ হলো মুক্তির রজনী, নাজাতের রাত্রি ইত্যাদি।
ইসলামি শরিয়ায় যে রাতগুলো অত্যন্ত ফজিলতপূর্ণ শবে বরাত তার একটি। এ রাতে প্রচুর সংখ্যক বান্দাকে আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করেন।
আল কুরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেন,‘হা-মিম! শপথ! উজ্জ্বল কিতাবের, নিশ্চয়ই আমি তা নাজিল করেছি এক বরকতময় রাতে; নিশ্চয়ই আমি ছিলাম সতর্ককারী। যাতে সব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্ধারিত হয়। এ নির্দেশ আমার তরফ থেকে, নিশ্চয়ই আমিই দূত পাঠিয়ে থাকি।’ (সুরা-৪৪ দুখান, আয়াত: ১-৫)।
মুফাসসিরিনগণ বলেন, এখানে ‘লাইলাতুম মুবারাকা’ বা বরকতময় রজনী বলে শাবান মাসে পূর্ণিমা রাতকেই বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে মাজহারি, রুহুল মাআনি ও রুহুল বায়ান)। হজরত ইকরিমা (রা.) প্রমুখ কয়েকজন তাফসিরবিদ থেকে বর্ণিত আছে, সুরা দুখান–এর দ্বিতীয় আয়াতে বরকতের রাত বলে শবে বরাতকে বোঝানো হয়েছে। (মাআরিফুল কোরআন)
এ রাতের ফজিলত ও আমলের ব্যাপারে বেশ কিছু নির্ভরযোগ্য ও বিশুদ্ধ হাদিসও পাওয়া যায়। মুআজ ইবনে জাবাল রা. থেকে বর্ণিত এক হাদিসে নবি সা. বলেন, আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবান তথা শাবান মাসের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে সৃষ্টির প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেন। আর এ রাতে তিনি মুশরিক ও বিদ্বেষপোষণকারী ব্যতীত সবাইকে ক্ষমা করে দেন। সহিহ ইবনে হিব্বান, হাদিস নং- ৫৬৬৫
অন্য এক হাদিস থেকে জানা যায়—
এ রাতে আল্লাহ তাআলা বনু কালবের ছাগলগুলোর পশমের চেয়ে বেশিসংখ্যক বান্দাকে ক্ষমা করেন।’ (ইবন মাজাহ: ১৩৮৯) কিন্তু বিশেষ কিছু লোক এ ক্ষমা থেকে বঞ্চিত হয়। মহানবী (সা.) বলেন, ‘শাবান মাসের মধ্যবর্তী রাতে আল্লাহ তাঁর সব বান্দাকে ক্ষমা করেন। তবে মুশরিক, হিংসুক, জাদুকর, ব্যভিচারী, মা-বাবার অবাধ্য সন্তান ও অন্যায়ভাবে হত্যাকারীকে ক্ষমা করেন না।’ ইবন মাজাহ: ১৩৯০আয়শা সিদ্দিকা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, একবার রাসুল (সা.) নামাজে দাঁড়ালেন এবং এত দীর্ঘ সিজদা করলেন—আমার মনে হচ্ছিল তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। আমি উঠে তার পায়ের বৃদ্ধা আঙ্গুল নাড়া দিলাম, আর তা নড়লোও। তিনি সিজদা থেকে উঠে নামাজ শেষ করে আমায় বললেন—হে আয়িশা, তোমার কী আশংকা হয়েছে? আমি বললাম হে আল্লাহর রাসূল, আপনার দীর্ঘ সিজদা থেকে আমার আশঙ্কা হয়েছিল আপনি মৃত্যুবরণ করেছেন কি না।’ তিনি বললেন, ‘তুমি কি জানো এটা কোন রাত?’ আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসুলই ভালো জানেন।’ তিনি বললেন, ‘এটা হলো অর্ধ শাবানের রাত। এ রাতে আল্লাহ তাআলা তাঁর বান্দাদের প্রতি মনোযোগ দেন, ক্ষমাপ্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন, অনুগ্রহপ্রার্থীদের অনুগ্রহ করেন। আর বিদ্বেষ পোষণকারীদের নিজ অবস্থাতেই ছেড়ে দেন।’ শুআবুল ইমান, খ. ৩, পৃ, ৩৮২
এসব হাদিস থেকে জানা যায়— এ রাতে সৃষ্টিজীবের প্রতি আল্লাহ ব্যাপাকভাবে রহমত বর্ষিত করেন। কেবল যারা মুশরিক তথা আল্লাহর সাথে অংশী স্থাপন করে এবং অন্যের ব্যাপারে হিংসা ও বিদ্বেষ পোষণ করে, এ মহান রজনীতেও তারা আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত হয়। তারা ক্ষমাপ্রাপ্ত হয় না। আরও ক্ষমাপ্রাপ্ত হয় না জাদুকর, ব্যাভিচারী—সে পুরুষ হোক কিংবা নারী এবং বাবা-মার অবাধ্য সন্তান।
মুহাদ্দিসগণের বক্তব্য হলো—যদি কোন বিশেষ সময়ে আল্লাহর পক্ষ থেকে মাগফিরাত ও ক্ষমার ঘোষণা করা হয়, তাহলে সে সময় অত্যধিক নেক আমলের প্রতি মনোযোগী হওয়া বান্দাদের উচিত ও দায়িত্বও বটে। যাতে সেও আল্লাহর রহমত পেয়ে ধন্য হয়। আর তার নাম লিপিবদ্ধ হয় আল্লাহর দরবারে ক্ষমা ও নাজাতপ্রাপ্তদের তালিকায়। ক্ষমা ও রহমত নাজিলের এই বিশেষ সময়ে আল্লাহর অবাধ্যতা ও সব ধরনের গুনাহ থেকে বিরত থাকাও বাঞ্ছনীয়। অন্যথায় আল্লাহর ক্রোধের রোশানলে পড়ে আখিরাত ধ্বংসের সমুহ সম্ভাবনা রয়েছে।
শবে বরাতের আমল
শবে বরাতের বিশেষ কিছু আমল আছে—যা করলে বান্দা আল্লাহর নৈকট্য লাভে ধন্য হয়। এ রাতের গুরুত্বপূর্ণ আমল হলো—রাতে নফল নামাজ পড়া এবং দিনে রোজা রাখা। নবি সা. বলেছেন—শাবানের মধ্য দিবস এলে তোমরা রাতে নফল ইবাদাত করবে, আর দিনে রোজা রাখবে। (ইবনে মাজাহ)।
অন্য এক হাদিসে নবী করিম (সা.) বলেন,
১৪ শাবান দিবাগত রাতে তোমরা ইবাদাত করবে, আর পরদিন দিনের বেলা রোজা রাখবে। কারণ, এদিন সূর্যাস্তের পর আল্লাহ তাআলা দুনিয়ার আসমানে নেমে আসেন এবং ডেকে বলতে থাকেন—কোনো ক্ষমা প্রার্থী আছ কি—আমি তাকে ক্ষমা করব? কোন রিজিক প্রার্থী আছ কি—আমি তাকে রিজিক দেব? কোন বিপদগ্রস্ত আছ কি—আমি তাকে উদ্ধার কিরব? এভাবে সুবহে সাদিক পর্যন্ত তিনি মানুষকে ডাকতে থাকেন। ইবনে মাজাহ, হাদিস নং- ১৩৮৪আমাদের প্রিয়নবি সা. প্রতিমাসের ৩, ১৪ ও ১৫ তারিখে রোজা রাখতেন—যা আইয়ামে বীজের রোজা নামে পরিচিত, যা মূলত সুন্নত। বিখ্যাত মুহাদ্দিস ফকিহ হাফিজ ইবনে রজব রহ. বলেন, এদিনের রোজা আইয়ামে বীজের রোজার অন্তর্ভুক্ত। (লাতায়িফুল মাআরিফ, পৃষ্ঠা: ১৫১)।
এ ছাড়া মাসের প্রথম তারিখ, মধ্য তারিখ ও শেষ তারিখ নফল রোজা রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শবে বরাতের রোজা এর আওতায়ও পড়ে।
সর্বোপরি রাসুল (সা.) রমজান মাসের পর শাবান মাসে সর্বাধিক নফল নামাজ পড়তেন ও রোজা রাখতেন। এমনকি শাবান মাসে কখনো ১০টি, কখনো ১৫টি, কখনো ২০টি, আবার কখনও এর অধিক রোজাও রাখতেন নবিজি। উম্মুহাতুল মুমিনিনগণ বর্ণনা করেছেন, রাসুল সা.শাবান মাসে এমনভাবে নফল রোজা রাখা শুরু করতেন, মনে হতো, তিনি আর কখনো রোজা ছাড়বেন না। সহিহ মুসলিম
শবে বরাতের ফজিলত ও আমল
- March 7, 2023
- 3:43 am
আরো পড়ুন