ন্যানো টেকনোলজি কি ? (what is Nanotechnology)
Nano শব্দটি গ্রীক Nanos থেকে এসেছে যার আভিধানিক অর্থ Dwari (বামন বা জাদুকরী ক্ষমতাসম্পন্ন ক্ষুদ্রাকৃতির প্রাণী) কিন্তু এটি মাপের একক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এক মিটারের ১০০ কোটি ভাগের ১ ভাগ হলো এক ন্যানো মিটার। আর এ ন্যানো মিটার স্কেলের সাথে যে সমস্ত টেকনোলজি সম্পর্কিত সেগুলোকেই ন্যানো টেকনোলজি (Nanotechnology) বলা হয়। ন্যানো টেকনোলজি হলো বিজ্ঞান, প্রকৌশল এবং প্রযুক্তি যা পরিচালিত হয় ন্যানো স্কেলে যেটি ১ থেকে ১০০ ন্যানো মিটার হয়ে থাকে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে অণু-পরমাণুকে জোড়া লাগিয়ে আগামী দিনে অনেক কিছু করা সম্ভব। ন্যানো প্রযুক্তি হলো পারমাণবিক বা অণুবিক স্কেলে অতিক্ষুদ্র ডিভাইস (যেমন- রোবোট) তৈরি করার জন্য ধাতব ও বস্তুকে সুনিপুণভাবে কাজে লাগানোর বিজ্ঞান।
ন্যানো টেকনোলজি কিভাবে কাজ করে?
সাধারণত ন্যানো টেকনোলজি (Nanotechnology) ১ থেকে ১০০ ন্যানোর স্কেলে পরিচালিত হয়ে থাকে। ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমে কোনো জিনিস এতটাই ক্ষুদ্র করে তৈরি করা যায় যে যদি একটি ১ সেন্টিমিটার বল এক ন্যানোমিটার হয় তাহলে পৃথিবীর সাইজ হবে এক মিটার । ন্যানো প্রযুক্তির ফলে কোন উপকরণকে এতটাই ক্ষুদ্র করে তৈরি করা যায় যে, এর থেকে আর ক্ষুদ্র করা সম্ভব নয়। এই পৃথিবীর সব কিছু যা আমরা খাই, যা আমরা পরি, ঘরবাড়ি যাতে আমরা বাস করি, আমাদের দেহের সব কিছু ইত্যাদি পরমাণু দিয়ে গঠিত। কিন্তু পরমাণু এতো ছোট যে খালি চোখে তা দেখা যায় না। ১৯৮০ সনে IBM এর গবেষকরা প্রথম আবিষ্কার করেন STM (Scarutning Tunneling Microscope) এই যন্ত্রটি দিয়ে অণুর গঠন পর্যন্ত দেখা সম্ভব । এই যন্ত্রটির আবিষ্কারই ন্যানো প্রযুক্তিকে বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছে।
ন্যানো টেকনোলজির মাধ্যমে অণু-পরমাণুকে ভেঙে কিংবা জোড়া লাগিয়ে আগামী দিনে অনেক কিছুই করা সম্ভব হবে। ন্যানো টেকনোলজির ক্ষেত্রে দুটি প্রক্রিয়া আছে। একটি হল উপর থেকে নিচে (Top to Bottom) ও অপরটি হল নিচ থেকে উপরে (Bottom to top)। টপ টু ডাউন পদ্ধতিতে কোন জিনিসকে কেটে ছোট করে তাকে নির্দিষ্ট আকার দেয়া হয়। এই ক্ষেত্র সাধারণত Eiching প্রক্রিয়াটি সম্পর্কিত। আর বটম টু টপ হল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আকারের ছোট জিনিস দিয়ে বড় কোন জিনিস তৈরি করা। আমাদের বর্তমান ইলেক্ট্রনিক্স হল, টপ টু ডাউন প্রযুক্তি। আর ন্যানো টেকনোলজি ( Nanotechnology ) হল, বটম টু টপ প্রযুক্তি। ন্যানো প্রযুক্তির সাহায্যে ন্যানোমিটার স্কেলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্তুর উপাদান দিয়ে কাঙ্ক্ষিত কোন বস্তু তৈরি করা যায়।
ন্যানো টেকনোলজির আবিষ্কারক কে ?
আমেরিকান পদার্থবিদ রিচার্ড ফেম্যান ( Richard Feynman) সর্বপ্রথম ১৯৫৯ সালের ২৯ ডিসেম্বর তার “There’s Plenty of Room at the Bottom ” আলোচনায় ন্যানো টেকনোলজি সম্পর্কে ধারণা দেন। রিচার্ড ফেম্যান হলেন ন্যানো টেকনোলজির আবিষ্কারক।
ন্যানো টেকনোলজির প্রয়োগ ক্ষেত্র (Application fields of Nanotechnology)
বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের প্রোডাক্ট তৈরিতে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। নিম্নে ন্যানো টেকনোলজির কিছু প্রয়োগক্ষেত্র উল্লেখ করা হল :
কম্পিউটার হার্ডওয়্যার তৈরি : কম্পিউটারের মেমোরি, গতি, দক্ষতা ইত্যাদি বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন হার্ডওয়্যার এবং ভিডিও গেমস কনসোল তৈরিতে ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহৃত হয়।
ন্যানো রোবট : ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহার করে অতি ক্ষুদ্র রোবট তৈরির গবেষণা চলছে। এ ধরনের রোবট মানবদেহের অভ্যন্তরে অস্ত্রোপচার করতে সক্ষম হবে।
ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রপাতি : বিদ্যুৎ খরচ, ওজন এবং আকৃতি কমিয়ে কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি তৈরিতে ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহৃত হয়। কম খরচে নিম্নমানের কাঁচামালের মাধ্যমে জ্বালানি তৈরি এবং বিভিন্ন প্রকার ব্যাটারি ও হাইড্রোজেনে ব্যাবহারের জন্য ফুয়েল সেল তৈরিতে ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহৃত হয়।
ক্যান্সার নির্ণয় ও নিরাময় : ন্যানোসেন্সর ব্যবহার করে মানবদেহের রক্তের ভেতরে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপাদান বায়োমার্কার সম্পূর্ণভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। ন্যানো সূঁচ ব্যবহার করে সূক্ষ্মভাবে শুধুমাত্র ক্যান্সার আক্রান্ত কোষে ঔষধ প্রয়োগ করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা যায়।
খেলাধুলার সামগ্রী : টেনিস বলের স্থায়িত্ব বৃদ্ধির জন্য, বাতাসে গলফ বলের পজিশন ঠিক রাখার জন্য, ব্র্যাকেটের শক্তি ও স্থায়িত্ব বৃদ্ধির জন্য ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও খেলোয়াড়দের জুতা, মোজা, ট্রাউজার প্রভৃতির স্থায়িত্ব বৃদ্ধি ও আরামপ্রদ করার জন্য ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহৃত হয়।
ন্যানো টেকনোলজির ভবিষ্যৎ (Future of Nanotechnology)
ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার চিকিৎসাক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সৃষ্টি হবে। যেমন ক্যান্সার চিকিৎসায়, রেডিয়েশন দিলে আক্রান্ত কোষ ছাড়াও আশেপাশের আরও অনেক ভাল কোষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে বিকলাঙ্গতা দেখা দিতে পারে। ন্যানো প্রযুক্তি কাজে লাগানো গেলে শুধুমাত্র আক্রান্ত কোষগুলোতেই রেডিয়েশন দেয়া যাবে। ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার চিকিৎসাবিজ্ঞান, ইলেকট্রনিক্স, শক্তি উৎপাদনসহ বহু ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে। একুশ শতাব্দিতে এসে আইটি নিয়ে যতটা কথা শোনা যাচ্ছে, ততোটাই শোনা যাচ্ছে এই ন্যানো প্রযুক্তি নিয়ে । জাপানী জাতীয় গবেষণা বাজেটের সিংহভাগই ব্যবহৃত হচ্ছে ন্যানো প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ে।
ইউরোপ, আমেরিকা, চীন, কোরিয়া ইত্যাদি দেশগুলো ন্যানোপ্রযুক্তির উপর ব্যাপক গবেষণা করছে। কেন ন্যানোপ্রযুক্তি নিয়ে সবার এত আগ্রহ ? তার একটা সহজ উত্তর হল, সামনের দিন হবে ন্যানো প্রযুক্তির যুগ। হৃদরোগ হয়েছে ? ন্যানো রোবোট শরীরের ভিতরে ঢুকে হার্টের সব সমস্যা মেরামত করে দেবে। হাতের ঘড়িটি হয়ে যাবে কম্পিউটার। ন্যানো টেকনোলজির কল্যাণে বিভিন্ন জিনিস হবে অনেক ছোট এবং হালকা।