Search
Close this search box.

ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি ? ভার্চুয়াল রিয়েলিটির উপাদান, ধরণ ও ব্যবহার।

Virtual Reality

প্রযুক্তি নির্ভর আধুনিক এই বিশ্বে মানুষ তার মেধা খাটিয়ে কল্পনাকে ফুটিয়ে তুলেছে বাস্তব চিত্রের মাধ্যমে। প্রকৃত অর্থে বাস্তব কোনো ঘটনা নয় কিন্তু মানুষ তার ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সেই ঘটনা গুলোকে অনুভব করতে পারবে যে বিজ্ঞান নির্ভর প্রযুক্তির সাহায্যে তাকে বলে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি বা সংক্ষেপে ভিআর।

ভার্চুয়াল রিয়েলিটি কি?

ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হলো এক ধরনের ত্রিমাত্রিক ইমেজ সিস্টেম যা কম্পিউটার প্রযুক্তি ও সিমুলেশন তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে একটি কৃত্রিম পরিবেশের আবহ সৃষ্টি করে এবং ব্যবহারকারীকে বাস্তব পরিবেশের অনুভূতি প্রদান করতে পারে। যেমন, একজন মানুষ তার ঘরে বসেই অনুভব করতে পারবে, সে মহাকাশ ভ্রমণ করছে অথবা সমুদ্রের অতলে অজানা রঙিন সব জীব ও মাছেদের সাথে কথা বলছে। মুহূর্তের মধ্যে সে পৌঁছে যেতে পারে পৃথিবী সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ এভারেস্টে।

বর্তমানে কমবেশি আমরা অনেকেই ভার্চুয়াল রিয়েলিটি শব্দটির সাথে বেশ পরিচিতি থাকলেও এর সূচনা ইতিহাস আনুমানিক প্রায় দেড়শো বছরেরও বেশি পুরনো। তখন অবশ্য বর্তমান অবস্থানের মতো ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যবহার বা ধারণা কারোরই তেমন পরিষ্কার ছিল না। ফরাসি কবি ও নাট্যকার অ্যান্টনিম আরচিউড সর্বপ্রথম ভার্চুয়াল রিয়েলিটি শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। ১৮৩৮ সালে অ্যান্টনিম আরচিউডের লেখা ”The Theatre and Double” নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সেই গ্রন্থেই তিনি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি শব্দটি উল্লেখ করেছিলেন।

পরবর্তীতে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ধারণা পাওয়া যায় আঠারো শতকে স্টেরিওস্কোপ আবিষ্কারের মাধ্যমে। সেখানে ইমেজ প্রজেক্ট তৈরি করার জন্য একটি টুইন মিরর ব্যবহার করা হয়েছিল। ডেমিয়েন ব্রডরিকের রচিত ”Thed Judus Mandala” নামক একটি সাইন্স ফিকশনেও এই শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবিক উপায়ে ভার্চুয়াল রিয়েলিটি উপস্থাপন করা হয়েছিল ১৯৬১ সালের দিকে। Morton Heilig সেন্সোরমা সিমুলেটর নামক একটি যন্ত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে বাস্তব ভার্চুয়াল রিয়েলিটি তুলে ধরেছিলেন। যদিও সেখানে কম্পিউটারের কোন প্রোগ্রাম বা কোন ধরনের সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়নি।

আধুনিক ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সূচনাকাল হিসেবে ১৯৮০ সাল কে গ্রহণ করা হয়ে থাকে। সেই সময়কাল থেকেই ত্রিমাত্রিক ইমেজ ব্যবহার করে থ্রিডি ও ফাইভডি প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কাল্পনিক দুনিয়া তৈরি করা ক্রমশ শুরু হতে থাকে।

আরও পড়ুন  মেটার ৬ হাজারের বেশি কর্মী চাকরি হারাচ্ছেন

ভার্চুয়াল রিয়েলিটির উপাদান

শুরুতেই আমরা জেনেছি, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হলো কম্পিউটার ভিত্তিক একটি প্রোগ্রাম। কম্পিউটারের হার্ডওয়ার ও সফটওয়ারের সাহায্যে তৈরি করা একটি ত্রিমাত্রিক চিত্রায়ন। এই ধরনের চিত্ররূপ তৈরির জন্য সর্বপ্রথম প্রয়োজন একটি শক্তিশালী কম্পিউটার যার মাধ্যমে উন্নত মানের গ্রাফিক্স ব্যবহার করা যাবে। শক্তিশালী কম্পিউটারের পাশাপাশি আর যে সকল উপাদান এই প্রযুক্তিতে ব্যবহার করা হয় সেগুলো হলো- রিয়েলিটি ইঞ্জিন বা সিমুলেটর, ইনপুট ও আউটপুট সেন্সর ডিভাইস, হেড মাউন্টেড ডিসপ্লে, ডেটা গ্লোব, একটি পূর্ণাঙ্গ বডি স্যুট, অডিও ডিভাইস ইত্যাদি।

ভার্চুয়াল রিয়েলিটির একটি বিশেষ দিক হলো এখানে দর্শন অনুভূতির পাশাপাশি শব্দ ও স্পর্শকেও সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়। দর্শনের জন্য যেমন বিশেষ চশমা ও হেলমেট ব্যবহার করা হয় ঠিক তেমনি স্পর্শ অনুভবের জন্য ব্যবহৃত হয় বিশেষ ধরনের গ্লাভস, বুট, স্যুট। কৃত্রিমভাবে শব্দের প্রতিরূপ তৈরি করে এমন ভাবে ভিডিও এর সাথে যুক্ত থাকে যেন মনে হয় বিশেষ কোনো স্থান থেকে শব্দ উচ্চারিত হচ্ছে। এই সম্পূর্ণ অত্যাধুনিক জটিল প্রক্রিয়াটি পরিচালনা করা হয় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন গ্রাফিক্স এর মাধ্যমে।

ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ধরণ

সাধারণত পাঁচ ধরনের ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সম্পর্কে এখন পর্যন্ত ধারণা লাভ করা সম্ভব হয়েছে।

প্রথমটি হলো fully-immersive। যদি কোন ব্যক্তি ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে এমন এক কাল্পনিক জগতের অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারে যা বাস্তব জগত থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং কিছুটা অসম্ভব সেটিকেব fully-immersive বলে। যেমন কেউ যদি ডাইনোসরের পিঠে চড়ার অভিজ্ঞতা শারীরিক ও মানসিকভাবে অর্জন করতে চায় সে fully-immersive ভার্চুয়াল রিয়েলিটি থেকে তা অর্জন করতে পারবে। এইখানে ব্যক্তিকে বিভিন্ন বডি কানেক্টরের সাথে যুক্ত করা যায়; যেগুলো ব্যক্তির সেন্সের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখতে পারে এবং মাউসের ডিরেকশন অনুযায়ী ব্যক্তির ইচ্ছানুযায়ী আচরণ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

Semi immersive নামক আরেক ধরনের ভার্চুয়াল রিয়েলিটি আছে যা মূলত Non-immersive ও fully-immersive ভার্চুয়াল রিয়েলিটির সংমিশ্রণ। এই ধরনের সিস্টেমে বিভিন্ন ধরনের ধরনের ডিভাইস ব্যবহার করা হয়। যেমন: computer screen, VR box, Headset ইত্যাদি। যদিও এখানে কম্পিউটার মাউসের মাধ্যমে মুভমেন্ট নিয়ন্ত্রণ করা যায় কিন্তু শারীরিকভাবে কোনো অভিজ্ঞতা semi-immersive এর মাধ্যমে সম্ভব নয়।

আরও পড়ুন  বাইক দীর্ঘদিন ভালো রাখতে যে বিষয়ে খেয়াল রাখবেন

তৃতীয়টি হলো Non-immersive।  Non-immersive এর মাধ্যমে সফটওয়্যার ভিত্তিক বিভিন্ন অ্যাক্টিভিটি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। বিভিন্ন ধরনের গেমিং ডিভাইস যেমন প্লেস্টেশন, এক্স বক্স কম্পিউটারের মাধ্যমে এ ধরনের অভিজ্ঞতা যে কেউ অর্জন করতে পারে। সাধারণত হাই কোয়ালিটির গ্রাফিক্স বা রিয়েলস্টিক গেম গুলোর মধ্যে চরিত্রগুলোকে Non-immersive ভার্চুয়াল রিয়েলিটির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

চতুর্থ এক ধরনের ভার্চুয়াল রিয়েলিটির নাম Augmented Reality। এর মাধ্যমে বর্তমান কোনো কিছুর সাথে নতুন কিছু সংযুক্ত হলে সেই পরিবেশটি কেমন দেখাবে তার একটি ধারণা পাওয়া যায়। যেমন নিজ বাসায় ফার্নিচারগুলো কিভাবে সাজালে দেখতে সুন্দর লাগবে এবং মানানসই হবে তা পূর্ব থেকে কম্পিউটারের Augmented Reality ধরনের ভিডিও এর সাহায্যে বুঝতে পারা যাবে।

Collaborative ভি-আর নামক আরেকটি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি আছে যার মাধ্যমে একই সাথে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্ন স্থান থেকে ভার্চুয়াল ক্যারেক্টার হিসেবে সংযুক্ত হতে পারে এবং চ্যাট অথবা মেসেজের মাধ্যমে যোগাযোগ রাখতে পারে।

ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যবহার

প্রযুক্তির বিকাশের সাথে দিনদিন ভার্চুয়াল রিয়েলিটির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন, শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে বর্তমানে ত্রিমাত্রিক ইমেজ ইফেক্ট ব্যবহার করা হয় ফলে যেকোনো বিষয় সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানার আগ্রহ আরও বেড়ে যায় এবং বেশ আকর্ষণীয় ভাবে উপস্থাপন করতে পারে। সেই সাথে একজন শিক্ষার্থীর কল্পনাশক্তি যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি তাকে আরো বেশি সৃজনশীল হতে সহায়তা করে।

ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহারের ফলে চিকিৎসা ক্ষেত্রে অনেক জটিল অস্ত্রোপচার এখন সহজভাবে করা সম্ভব হচ্ছে। শক্তিশালী একটি ডায়াগনস্টিক টুল হিসেবে ভিআরকে ব্যবহার করে রোগী ও চিকিৎসকদের পরিশ্রম অনেকাংশে কমে যাচ্ছে।

সামরিক ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল রিয়েলিটির প্রয়োগের মাধ্যমে অনেক জটিল মিলিটারি প্রশিক্ষণ এখন সিমুলেটরের সাহায্যে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। এতে করে সৈন্যরা অধিক বাস্তবসম্মত ট্রেনিং গ্রহণ করতে পারছে।

বিল্ডিং বা স্থাপত্য তৈরিতে ভিআর প্রযুক্তি ব্যবহার করে পূর্ব থেকে নকশার যথার্থতা সম্পর্কে সঠিক ধারণা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে। স্থপতিরা থ্রিডি প্রযুক্তি ব্যবহার করে ডিজাইনের সঠিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে পারে যার ফলে সময় ও অর্থ  উভয়ই সাশ্রয় করা সম্ভব হচ্ছে।

আরও পড়ুন  'উন্নত ক্যামেরা ও প্রসেসরযুক্ত ইনফিনিক্স স্মার্টফোন কর্মসংস্থান তৈরি করতে সক্ষম'

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও বিভিন্ন ধরনের গেমিং সিস্টেমের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি ভার্চুয়াল রিয়েলিটি প্রয়োগ করা হচ্ছে। বেশি উন্নত মানের গ্রাফিক্স ব্যবহারের ফলে উল্লেখিত মাধ্যমগুলোকে ব্যবহারকারীদের কাছে আরও বেশি আকর্ষণীয় ও জনপ্রিয় হচ্ছে।

ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহারের আরেকটি দিক হচ্ছে ড্রাইভিং প্রশিক্ষণ। এই প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে খুব সহজেই ড্রাইভিং-এর বিভিন্ন নিয়ম কানুন শেখা সম্ভব হচ্ছে। প্রশিক্ষণের এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হয় কম্পিউটার সিমুলেশন এর মাধ্যমে। যেখানে চালককে একটি নির্দিষ্ট আসনে বসতে হয় এবং কাল্পনিক বাস্তবতায় ড্রাইভিং এর বিভিন্ন নির্দেশনা অনুসরণ করে ও গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

ভার্চুয়াল রিয়েলিটির নেতিবাচক দিক

ভার্চুয়াল রিয়েলিটি যেমন আমাদের পৃথিবীকে আধুনিক করে তুলছে ঠিক তেমনি এর কিছু নেতিবাচক দিকও আমাদের জীবনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে।

প্রথমত, এই প্রযুক্তি বেশ ব্যয়বহুল। ফলে সকল দেশের সকল শ্রেনীর মানুষ এই সুবিধা সমানভাবের ভোগ করতে পারে না। যার কারণে এক ধরনের অর্থনৈতিক ও জীবমানের অসমতা সৃষ্টি হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, যেহেতু ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সম্পূর্ণ কল্পনা নির্ভর একটি জগত তাই মানুষের সাথে বাস্তবতার সম্পর্ক দিন দিন কমে যাচ্ছে। যা মানুষের মনুষ্য হীনতা বৃদ্ধির কারণ হতে পারে।

তৃতীয়ত, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি সাধারণ বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসের সাহায্যে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অতিরিক্ত ডিভাইসের ব্যবহারের ফলে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। তাই আমাদের উচিত সঠিকভাবে বিজ্ঞানের এই চমৎকার প্রযুক্তিটি ব্যবহার করা।

আরো পড়ুন

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top