খুলনা জেলা বাংলাদেশের খুলনা বিভাগের একটি জেলা। এর উত্তরে যশোর জেলা ও নড়াইল জেলা দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, পূর্বে বাগেরহাট জেলা এবং পশ্চিমে সাতক্ষীরা জেলা অবস্থিত। এটি ১৮৪২ সালে যশোর জেলার অধীনে প্রতিষ্ঠিত ইউনাইটেড বেঙ্গল প্রদেশের প্রথম মহকুমা। ১৮৮২ সালের ১লা জুন কলকাতা থেকে প্রকাশিত সরকারি গেজেটের প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে যশোর জেলার খুলনা ও বাগেরহাট মহকুমা এবং চব্বিশ পরগনা জেলার সাতক্ষীরা মহকুমার নতুন জেলা ‘খুলনা’ গঠন করা হয়।
খুলনা জেলায় অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যার মধ্যে রয়েছে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়,খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়,খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। খুলনা বিভাগ যেমন শিক্ষার দিক থেকে উন্নত তেমনি এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এতটাই সুন্দর যে প্রতি বছর বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটক খুলনা জেলায় ঘুরতে আসে।
চলুন দেখে নিই খুলনা জেলার দর্শনীয় স্থাসমূহ / খুলনা জেলার পর্যটন স্থান:
১. ভুতিয়ার পদ্মা বিল
২. পুটনি দ্বীপ
৩. হিরণ পয়েন্ট
৪. বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের সমাধি
৫. খুলনা বিভাগীয় জাদুঘর
৬. খান জাহান আলী সেতু
৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ি
৮. বঙ্গবন্ধু দ্বীপ
৯. শহীদ হাদিস পার্ক
১০. করমজল পর্যটন কেন্দ্র
খুলনা জেলার ১০টি দর্শনীয় স্থান:
১. ভুতিয়ার পদ্মা বিল
ভুতিয়ার পদ্মা বিল খুলনা জেলার তেরখাদা উপজেলায় অবস্থিত। প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে এই পদ্মা বিল যেন এক স্বর্গরাজ্য। পুরো বিল জুড়ে ফুটেছে হাজারো পদ্ম। এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্যটি ব্যস্ত নাগরিক জীবনের ক্লান্তি দূর করতে জাদুর মতো কাজ করে। ভুতিয়ার পদ্মবিল ঘেঁষে থাকা গ্রাম বাংলার অত্যাশ্চর্য প্রকৃতিকে প্রতিফলিত করে যা আগের মতো সর্বত্র দেখা যায় না। সকাল ৬ টা থেকে ৬:৩০ টা পর্যন্ত পদ্ম ফুল দেখার উপযুক্ত সময়। কারণ সন্ধ্যা বাড়ার সাথে সাথে পদ্মও পাপড়ি বন্ধ করে দিতে থাকে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর হল ভুতিয়ার পদ্মবিল দেখার আদর্শ সময়।
২. পুটনি দ্বীপ
খুলনা জেলার নৈসর্গিক প্রকৃতিতে অবস্থিত একটি দ্বীপের নাম পুটনি দ্বীপ। বাসিন্দাদের কাছে এর অপর নাম দ্বীপচর। পুটনি দ্বীপের একপাশে সবুজ ঘাসের প্রান্তর এবং জিগজ্যাগ খাল সহ দিগন্তে সমুদ্র এবং অন্যদিকে ঘন বন রয়েছে। পুটনি দ্বীপ এক কথায় অসাধারণ। জোয়ারে স্ফীত হওয়ার সাথে সাথে পুরো এলাকা ভেসে ওঠে শেষ বিকেলের সূর্যাস্ত এখানে আড়পাঙ্গাসিয়া নদী এবং বঙ্গোপসাগরের মোহনায়। পুটনি একটি হরিণ এবং মাছের অভয়ারণ্য রয়েছে। তবে আশেপাশের অনেক স্থানীয় মানুষ কাঁকড়া আহরণ করতে পুটনি দ্বীপে আসে। দ্বীপের বন ও খাঁড়িতে হরিণ ও মাছের বিচরণ থাকলেও বাঘের উপদ্রব নেই বলে জানা গেছে।
৩. হিরণ পয়েন্ট
হিরণ পয়েন্ট হল বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের দক্ষিণ অংশে খুলনা রেঞ্জের প্রমত্তা কুঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত একটি সুরক্ষিত অভয়ারণ্য। নীলকমল হিরণ পয়েন্টের আরেকটি নাম ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের একটি। এটি খুলনার একটি বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান। এটি অভয়ারণ্য হওয়ায় হিরণ পয়েন্ট দ্রুত বন্যপ্রাণী, সরীসৃপ এবং বানর, হরিণ এবং বাঘ সহ পাখিদের জন্য একটি নিরাপদ, প্রাকৃতিক আবাসস্থল হয়ে উঠেছে। ফলস্বরূপ এখানে সুন্দরবনের অন্যতম আকর্ষণ হল রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, বড় ইগ্রেট, ক্রাইং প্রিক, ধানী বক ইত্যাদি প্রাণীর দেখা যায়।
৪. বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিনের সমাধি
খুলনা জেলার রূপসা নদীর পূর্বপাড়ে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন সামরিক খেতাবের শ্রেষ্ঠ শহীদ মোহাম্মদ রুহুল আমিন (বীরশ্রেষ্ঠ রুহুল আমিন কবরস্থান)। ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছে একটি যুদ্ধজাহাজে শত্রূর বিমান হামলায় শহীদ হন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। রুহুল আমিনের শাহাদাতবার্ষিকী ও সশস্ত্র বাহিনী দিবসে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও স্থানীয় প্রশাসন বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করে রাহুল আমিনের কবরস্থানে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
৫. খুলনা বিভাগীয় জাদুঘর
১২ সেপ্টেম্বর, ১৯৯৮ সালে খুলনা জেলা শহরের শিববাড়ি মোড় সংলগ্ন পাবলিক হলের পাশে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম খুলনা বিভাগীয় জাদুঘর প্রতিষ্ঠিত হয়। দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী স্থান ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় স্থাপনার ছবি এই জাদুঘরের আকর্ষণ। যশোরের ভারত ভায়ানা, ঝিনাইদহের বারোবাজার এবং বাগেরহাটের খান জাহান আলী সমাধিসৌধের মতো বিভিন্ন স্থানে খননের মাধ্যমে পাওয়া দুর্লভ নিদর্শনগুলো খুলনা বিভাগীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
৬. খান জাহান আলী সেতু
খান জাহান আলী সেতু জীবনানন্দের রূপসা নদীর উপর নির্মিত যা রূপসা সেতুর চেয়েও বেশি জনপ্রিয়। রূপসা সেতুর মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের সকল জেলা এবং মংলা সমুদ্রবন্দরের সাথে সড়ক যোগাযোগের কারণে এটি খুলনা শহরের প্রবেশদ্বারও। জাপানি সাহায্যপ্রাপ্ত রূপসা সেতু উৎসব ও সপ্তাহান্তে খুলনাবাসীর জন্য একটি চমৎকার গন্তব্য হয়ে উঠেছে। রূপসা সেতুর দৈর্ঘ্য ১.৬০ কিলোমিটার। সেতুটিতে পথচারী ও যান্ত্রিক যানবাহন চলাচলের জন্য বিশেষ লেন রয়েছে। মূল সেতুতে ওঠার জন্য দুই প্রান্তে চারটি ধাপও রয়েছে।
৭. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ি
বিভাগীয় শহর খুলনা থেকে মাত্র ১৯ কিলোমিটার দূরে ফুলতলা উপজেলার দোকখিন্দি গ্রামের অবস্থান। দোকখিন্দি গ্রামে এককালের একটি চমৎকার রায় বাড়ি এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুর বাড়ি রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ি এখন ‘রবীন্দ্র কমপ্লেক্স’ নামে পরিচিত। রবীন্দ্র কমপ্লেক্স খুলনা শহরের একটি বিখ্যাত এবং ঐতিহাসিক স্থান। এখানে রয়েছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রীর আবক্ষ মূর্তি ও একটি দোতলা টাওয়ার। বাড়িটিও সজ্জিত করা হয়েছে সবুজ বাগান, পান বার্জ এবং নার্সারি দ্বারা।
৮. বঙ্গবন্ধু দ্বীপ
খুলনার সেরা জায়গাগুলো দেখতে চান তাহলে বঙ্গবন্ধু দ্বীপ উপভোগ করার উপযুক্ত জায়গা। বঙ্গবন্ধু দ্বীপ খুলনা বিভাগের মংলা উপজেলায় দুবলার চর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে হিরণ পয়েন্ট এবং দুবলার চরের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে অবস্থিত। চরটির প্রায় ১০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা রয়েছে যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২ মিটার উপরে অবস্থিত। আশেপাশে স্থানীয় জেলেরা মাছ ধরার সময় বঙ্গবন্ধু দ্বীপের সন্ধান পেলেও চর আবিষ্কারের সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
৯. শহীদ হাদিস পার্ক
শহীদ হাদিস পার্ক খুলনার বাবুখান রোডে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক পার্ক যা ১৮৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হলেও পরবর্তীতে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানে শহীদ শেখ হাদিছুর রহমান বাবুর নামে নামকরণ করা হয়। শহীদ হাদিস পার্কে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অনুকরণে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। হাদিস পার্কে রয়েছে বিস্তীর্ণ লেক। লেকের ওপর নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ মিনার ও পানির ফোয়ারা।
১০. করমজল পর্যটন কেন্দ্র
খুলনা শহরে অনেক সুন্দর জায়গা আছে। করমজল পর্যটন স্পট সুন্দরবনের পশুর নদীর তীরে অবস্থিত। বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে মংলা সমুদ্রবন্দর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে ৩০ হেক্টর জমিতে গড়ে উঠেছে পর্যটন স্পট। একদিনে সুন্দরবন ভ্রমণের স্বাদ নিতে চাইলে করমজল সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা। কুমির, হরিণ, রিসাস বানর সহ বিভিন্ন প্রাণী প্রকৃতির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে।
এছাড়া কাঠের ট্রেইল, টাওয়ার এবং জেলেদের মাছ ধরার কর্মীদের অতিরিক্ত প্রাপ্তি। করমজল বাংলাদেশের একমাত্র কুমিরের প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্র।